অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : রাজীব গান্ধী হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত নলিনী শ্রীহরণ মুক্তি পেয়েছেন। ৩১ বছর পর জেল থেকে বেরিয়েছেন তিনি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ লাঘব হয়েছে।
জেল থেকে বেরিয়ে নলিনী একাধিক সাক্ষাৎকারে সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছেন। তাঁর দাবি, রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ডে তাঁর আদতে কোনও ভূমিকাই ছিল না। তিনি আদতে নির্দোষ।
নলিনী জানিয়েছেন, স্বামী মুরুগানের কিছু বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন তিনি। সেই কারণেই গোটা পরিকল্পনায় তাঁর নাম জড়িয়ে গিয়েছিল। তিনি সাজাও পেয়েছেন সেই কারণেই। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার চক্রান্তে তাঁর আদৌ সরাসরি কোনও হাত ছিল না, দাবি নলিনীর।
নলিনী বলেছেন, ‘‘আমি জানি, আমি দোষী সাব্যস্ত হয়েছি। কিন্তু আমার বিবেক জানে আমি নির্দোষ। আমার স্বামীর কিছু বন্ধুর জন্য আমি ফেঁসে গিয়েছি। ওঁদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। দোকান, বাজার, মন্দির, সিনেমা হল কিংবা হোটেলে ওঁদের সঙ্গে আমিও যেতাম। কিন্তু সে ভাবে কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলতাম না। ওঁদের সঙ্গে আমার কোনও ব্যক্তিগত যোগাযোগও ছিল না।’’
স্বামীর বন্ধুদের সঙ্গে নানা জায়গায় যেতেন নলিনী। তাঁদের নানা সময় সাহায্যও করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘ওঁরা যা চেয়েছিল, আমি তাতে সাহায্য করেছিলাম মাত্র। যেমন ওঁদের সঙ্গে দোকানে গিয়েছি, হোটেলে কিংবা সিনেমা হলে গিয়েছি। এ ছাড়া ওঁদের সঙ্গে আমার আর কোনও সম্পর্ক ছিল না।’’
নলিনী আরও জানান, দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ৭ বার মৃত্যুদণ্ডের আদেশপত্র হাতে পেয়েছিলেন তিনি। ৭ বার মৃত্যুভয় তাঁকে গ্রাস করেছিল। পরে মৃত্যুদণ্ড হ্রাস করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয় তাঁকে।
২০০১ সালে নলিনীর মৃত্যুদণ্ড হ্রাস করে সুপ্রিম কোর্ট। তার আগে ৭ বার কারাগারে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশপত্র দেওয়া হয়েছিল। পরে সনিয়া গান্ধীর হস্তক্ষেপে তা কমে যাবজ্জীবন কারাবাসের নির্দেশ দেওয়া হয়।
চেন্নাইয়ের একটি কলেজ থেকে ইংরাজি সাহিত্যে স্নাতক পাশ করেন নলিনী। তাঁর বাবা ছিলেন পেশায় পুলিশ। মা ছিলেন নার্স। চেন্নাইয়ের একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করতেন নলিনী।
নলিনীর পরিবারের কেউ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে মুরুগানের বন্ধুত্ব ছিল। সেই সূত্রে নলিনীর সঙ্গে রাজীব-হত্যায় অন্যতম অভিযুক্ত মুরুগানের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়।
১৯৯১ সালের ২১ মে তামিলনাড়ুর শ্রীপেরমবুদুরে নির্বাচনী জনসভায় আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। সেই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন মুরুগান, নলিনী-সহ মোট ৬ জন। প্রথমে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। পরে সাজা মওকুপ হয়।
রাজীব গান্ধীকে হত্যা করেছিলেন ধানু নামের এক মহিলা। লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলম (এলটিটিই)-র সদস্য ছিলেন সে। নির্বাচনী জনসভায় পুষ্পস্তবকের মধ্যে বোমা বেঁধে নিয়ে সটান প্রধানমন্ত্রীর সামনে হাজির হয় সে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তীব্র বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তার দেহ। মৃত্যু হয় রাজীবেরও। শ্রীলঙ্কা থেকে নৌ-পথে দু’মাস আগে এলটিটিই প্রধান ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের নির্দেশে ভারতের মাদ্রাজ (এখনকার চেন্নাই) শহরে আসে রাজীব গান্ধীকে হত্যা করার জন্য।
শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধ বন্ধ করার লক্ষ্যে ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনীকে শ্রীলঙ্কায় মোতায়েন করা হয়। ১৯৮৭ সালে ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী শ্রীলঙ্কার তামিল জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহী দলগুলোকে, বিশেষত এলটিটিইকে, নিরস্ত্র করার প্রচেষ্টা চালায়। ভারতীয় সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল যে, ভারতীয় শান্তিরক্ষীরা শ্রীলঙ্কায় বড় ধরনের কোনও সামরিক অভিযান চালাবে না। কিন্তু মোতায়েন হওয়ার কয়েক মাস পরে তারা এলটিটিই যোদ্ধাদের সঙ্গে অনেকগুলো খণ্ডযুদ্ধে লিপ্ত হয়। শ্রীলঙ্কায় সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত ছিল রাজীবের।
১৯৯০ সালে ‘সানডে’ পত্রিকার এর ২১শে অগস্ট সংখ্যায় রাজীব গান্ধী একটা সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তিনি বলেন, পরবর্তী নির্বাচনের পর যদি তিনি প্রধানমন্ত্রী হন, তা হলে শ্রীলঙ্কায় আবার ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানো হবে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ, এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হওবার পরই এলটিটিই মরিয়া হয়ে উঠে রাজীব গান্ধীকে হত্যা করার জন্য।
উত্তর-পূর্ব শ্রীলঙ্কায় বেড়ে ওঠা একটি তামিল জঙ্গি সংগঠন ছিল এলটিটিই। সেই দলের সদস্য ছিলেন নলিনীর স্বামী মুরুগানও। সেই সূত্রেই রাজীব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নলিনীর যোগসূত্র।
রাজীব হত্যাস্থলে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিলেন। এক মাত্র বেঁচে যান নলিনী। নিহত এক চিত্রগ্রাহকের ক্যামেরায় তাঁর এবং বাকিদের ছবি ধরা পড়েছিল। সেই সূত্রে নলিনীদের গ্রেফতার করা হয়।
মুরুগান এবং নলিনীর কন্যা সন্তান জন্ম নেয় কারাগারে। ১৯৯২ সালে নলিনী জেলের মধ্যে সন্তান প্রসব করেন। মেয়েটির ২ বছর বয়সে তাঁকে মায়ের থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়। জেলের বাইরে বড় হয়ে ওঠেন নলিনীর মেয়ে হরিথ্রা।
জেল থেকে বেরিয়ে এ বার সেই মেয়ের কাছেই চলে যেতে চান নলিনী। তাঁর মেয়ে বর্তমানে ব্রিটেনে থাকেন। সেখানে তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক। মেয়ের কাছে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চান নলিনী।
তিনি জানিয়েছেন, তাঁর মেয়ে তাঁকে ভুলেই গিয়েছে। এত বছর মাকে ছাড়া থেকেছে সে। এখন দু’জনেই প্রাপ্তবয়স্ক। তাই মেয়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে মেয়ে তাঁকে বুঝবেন, আশাবাদী নলিনী।
চলতি বছরের মে মাসে সুপ্রিম কোর্ট রাজীব খুনের মামলায় আর এক যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পেরারিভালনকে মুক্তি দিয়েছিল। তার পর নলিনী এবং রবিচন্দ্রন ওই একই যুক্তি দেখিয়ে মাদ্রাজ হাই কোর্টে মুক্তির আবেদন জানান। গত জুন মাসে মাদ্রাজ হাই কোর্ট এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানাতে ‘পরামর্শ’ দেয় নলিনীদের। তার পরেই শনিবার তিন দশক জেলবন্দি নলিনীদের মুক্তি দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
মুক্তির দাবিতে গত তিন দশকে একাধিক বার অনশন করেছেন নলিনী। বছর দু’য়েক আগে এক বার ভেলোর সংশোধনাগারে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন তিনি। অবশেষে মিলেছে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি। নতুন করে জীবন শুরু করার স্বপ্ন দেখছেন এই তামিল-কন্যা। সূত্র: আনন্দবাজার
Leave a Reply